দোয়া স্বতন্ত্র একটি ইবাদত। আল্লাহর কাছে মানুষ যত চাইবে আল্লাহ তত দেবেন। আল্লাহ চান বান্দা প্রতিটি বিষয়ে তার কাছে প্রার্থনা করুক। বান্দা যত চায় আল্লাহ তাতে তত খুশি হন। তবে দোয়া কবুলের জন্য কিছু নির্দিষ্ট শর্ত ও আদব আছে। নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনে দোয়া করলে আশা করা যায় আল্লাহ তা কবুল করবেন। দোয়া কবুলের জন্য দিনরাতের মাঝে এমন অনেক সময় ও মুহূর্ত রেখেছেন, যে সময় দোয়া করলে তা কবুল হয় বলে হাদিসে বিভিন্নভাবে বলা হয়েছে। দোয়া কবুলের কয়েকটি মুহূর্তের কথা এখানে আলোচনা করা হলো

১. রাতের শেষ তৃতীয়াংশের যদি দোয়া করা হয়, তাহলে তা কবুল হয়



 রাতের শেষ তৃতীয়াংশের দোয়া অবশ্যই কবুল করা হয়। হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক রাতের শেষ তৃতীয়াংশে আল্লাহ মহান সবচেয়ে কাছের আকাশে নেমে আসেন এবং বলেন, কে আমাকে ডাকছো? আমি তোমার ডাকে সাড়া দেব। কে আমার কাছে চাইছো? আমি তাকে তা দেব। কে আছো আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনাকারী’ আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব। (মুসলিম)

২. জুমার দিনের দোয়া অবশ্যই কবুল করা হয়

 হাদিসে এসেছে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) আমাদের একদিন শুক্রবারে ফজিলত নিয়ে আলোচনা করছিলেন । আলোচনায় সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘জুমার দিনে এমন একটি সময় আছে, যে সময়টায় যদি কোনো মুসলিম নামাজ আদায়রত অবস্থায় পায় এবং আল্লাহর কাছে কিছু চায়, আল্লাহ মহান অবশ্যই তার সে চাহিদা বা দোয়া কবুল করবেন এবং এরপর রাসূল (সা.) তার হাত দিয়ে ইশারা করে সময়টা সংক্ষিপ্ততার ইঙ্গিত দেন।’ (বুখারি)

আবু দারদা ইবনে আবু মুসা আশআরি (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আমার পিতাকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি জুমার দিনের বিশেষ মুহূর্তটি সম্পর্কে বলেছেন, ইমামের মিম্বরে বসার সময় থেকে নামাজ শেষ করা পর্যন্ত সময়টিই সেই বিশেষ মুহূর্ত। (মুসলিম, মিশকাত)

রাসুল (সা.) থেকে জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন, জুমার দিনে ১২ ঘণ্টা রয়েছে। তাতে এমন একটা সময়ে রয়েছে, যাতে আল্লাহর বান্দা আল্লাহর ক‍াছে যা চায় আল্লাহ তাই দেন। অতএব তোমরা আছরের শেষ সময়ে তা তালাস করো। (আবু দাউদ, হাদিস নং : ১০৪৮, নাসাঈ, হাদিস নং : ১৩৮৯)

আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.) বর্ণনা করেন, শুক্রবারে আছরের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দোয়া কবুল হয়। বিখ্যাত সিরাতগ্রন্থ যাদুল মাআ’দ-এ বর্ণিত আছে, জুমার দিন আছরের নামাজ আদায়ের পর দোয়া কবুল হয়।

৩. আজান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়ের দোয়া কবুল হয়

হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘আজান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়ের দোয়া করা হলে তা ফিরিয়ে দেয়া হয় না।’ (তিরমিজি)

৪. সেজদারত অবস্থায় দোয়া করা হলে তা কবুল হয়

 রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে সময়টাতে বান্দা আল্লাহর সবচেয়ে নিকটতম অবস্থায় থাকে তা হলো সেজদারত অবস্থা। সুতরাং তোমরা সে সময় আল্লাহর কাছে বেশি বেশি চাও বা প্রার্থনা করো।’ (মুসলিম)

৫. জমজমের পানি পান করার সময়ের দোয়া করা হলে তা কবুল হয়

 রাসূল (সা.) বলেন, ‘জমজম পানি যে নিয়তে পান করা হবে, তা কবুল হবে।’ অর্থাৎ এই পানি পান করার সময় যে দোয়া করা হবে, ইনশাআল্লাহ তা অবশ্যই কবুল হবে। (ইবনে মাজাহ)

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দুই সময়ের দোয়া ফেরানো হয় না। আজানের সময়ের দোয়া আর বৃষ্টি পড়ার সময়কার দোয়া।’ (আবু দাউদ)

এছাড়াও কদরের রাতের দোয়া, নির্যাতিত ব্যক্তির দোয়া, মুসাফিরের দোয়া, সন্তানের জন্য মা-বাবার দোয়া, রোজাদার ব্যক্তির দোয়া, বিশেষ করে ইফতারের সময়কার দোয়া, অনুপস্থিত মুসলিম ভাই বা বোনের জন্য অন্তর থেকে উৎসারিত দোয়া, জিহাদের মাঠে শত্রুর মুখোমুখি দোয়া, আরাফার (হজের দিন) দিনের দোয়া, অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়ার পর সেই ব্যক্তির দোয়া কবুল হয় বলে হাদিসে উল্লেখ আছে।

দোয়া করার নিয়ম 


১. পবিত্রতা অর্জন

পবিত্রতা অর্জনের পর দোয়া করলে আল্লাহতায়ালা সেই দোয়া কবুল করবেন।

২. বিনয়ের সঙ্গে দোয়া করা


বিনয়ের সঙ্গে দু’হাত তুলে দোয়া করা। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালার নিকট হাত তুলে হাতের তালু সামনে রেখে দোয়া কর। হাত উল্টো করো না। দোয়ার শেষে উত্তোলিত হাত মুখমন্ডলে বুলিয়ে নাও।’ -আবু দাউদ

৩. দু’হাত তুলে দোয়া করা


বিনয়, নম্রতা ও দাসত্ব প্রকাশ করার জন্য দোয়ার সময় দু’হাতের তালু আসমানের দিকে রাখতে হবে এবং হাত সম্পূর্ণ সম্প্রসারিত করে দু’হাতের মধ্যে ২/১ আঙ্গুল পরিমাণ ফাঁক রাখতে হবে। হাত কচলানো, রশি পাকানোর মতো হাতের তালু ঘষাঘষি করা দোয়ার আদবের খেলাপ।হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে, ‘যে হাত আল্লাহর দরবারে উত্তোলিত হয়, তা একেবারে শূণ্য অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে তিনি লজ্জাবোধ করেন।’৪. আল্লাহর প্রশংসা ও দরুদ শরীফসহ দোয়া করা
আল্লাহর প্রশংসা ও দরুদ শরীফসহ দোয়া করা। আল্লাহর প্রশংসা যেমন, ‘আলহামদু লিল্লাহি রব্বিল আলামিন’
দোয়ার শুরুতে বলা। এছাড়া ইসমে আজমের সহিত দোয়া করা উত্তম। হজরত আসমা বিনতে ইয়াজিদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ইসমে আজম এই আয়াতদ্বয়ে রয়েছে-

১. সূরা বাক্বারা : ১৬৩
২. সূরা আল ইমরান : ১

হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদিন রাসূলে কারিম (সা.)-এর নিকট বসেছিলাম। একজন লোক সেখানে নামাজ পড়ছিল। সে তার দোয়ার মধ্যে আরজ করল, হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আমার প্রয়োজন প্রার্থনা করছি এই ওসিলায় যে, প্রশংসা ও গুনকীর্তণ আপনার জন্যই উপযুক্ত। আপনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। আপনি পরম দয়ালু ও অসীম অনুগ্রহদাতা এবং পৃথিবী ও আকাশ মন্ডলীর স্রষ্টা। আমি আপনার কাছেই আপনার অনুগ্রহ চাই। ইয়া হাইয়্যু ইয়া কাইয়্যু! ইয়া জালজালালী ওয়াল ইকরাম! রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, এ বান্দা আল্লাহর ইসমে আজমের ওসিলায় দোয়া করেছে। এ ওসিলায় আল্লাহর কাছে দোয়া করলে দোয়া কবুল হয় এবং আল্লাহর কাছে কোনো কিছু চাইলে, আল্লাহ তা দান করেন। -তিরমিজি

হজরত ফুজালা ইবনে উবায়দা (রা.) বর্ননা করেন, রাসূলে কারিম (সা.) এক ব্যক্তিকে দোয়া করতে শুনলেন। সে দোয়ায় আল্লাহপাকের প্রশংসা করল না এবং রাসূল (সা.)-এর ওপর দরুদও পাঠ করল না। এতে রাসূলে আকরাম (সা.) বললেন, লোকটি তড়িঘড়ি করে দোয়া করেছে। তিনি লোকটিকে ডেকে আনলেন এবং তাকে অথবা উপস্থিত লোকদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘যখন তোমাদের কেউ নামাজ পড়ে তখন দোয়া করার পূর্বে তার উচিত আল্লাহতায়ালার প্রশংসা করে নেয়া ও রাসূলের প্রতি দরুদ পাঠ করা। এরপর যা ইচ্ছা তা চাওয়া। -তিরমিজি ও আবু দাউদ

এক হাদিসে এসেছে হজরত রাসূলে মাকবুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দোয়া করার পূর্বে দরুদ শরীফ পড়ে, তার দোয়া অবশ্যই কবুল হয়। মহান আল্লাহতায়ালা অসীম দয়ালু; দোয়ার কিয়দাংশ কবুল করে অপর অংশ কবুল না করা তার স্বভাব নয়। এই হাদিসের সারমর্ম এই যে, দরুদ তিনি অবশ্যই কবুল করে থাকেন, সুতরাং তিনি দরুদ কবুল করে দোয়ার অবশিষ্টাংশ অর্থাৎ প্রার্থনীয় বিষয় অগ্রাহ্য করেন না। শেষ পর্যন্ত উভয় অংশই কবুল করেন।

হজরত আবু সোলায়মান দারানী (রহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে কোনো দোয়া করে, তার উচিত, প্রথমে দরুদ পড়া এবং দরুদ পড়ে দোয়া শেষ করা। কেননা আল্লাহ উভয় দরুদ কবুল করেন। -কিমিয়ায়ে সাআদাত